নিরাপত্তাহীনতায় পুলিশরাও

প্রকাশঃ নভেম্বর ১, ২০১৫ সময়ঃ ৬:২৭ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৬:৪৯ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

policeপুলিশের হাতে সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয় এ দৃষ্টান্ত যেমন আছে তেমনি দুর্বৃত্তদের হাতেও পুলিশকে প্রাণ দিতে হয়েছে-এমন ঘটনাও কম নয়। বাড়ি কিংবা রুমের মধ্যে যখন পুলিশের সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধে বা হার্ট অ্যাট্যাকের অপবাদে প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে, অপরাধীচক্র তবুও থেমে নেই। পুলিশের ন্যক্কারজনক আচরণ কিংবা পুলিশের সাথে ন্যক্কারজনক আচরণ যেটাই হোক না কেন বিবেকবানদের সর্বদাই তাড়া করে বেড়ায়। কারো মৃত্যু হয় সম্মানের আর কারোটা হয় অসম্মানের। কেউ জানে না তার মৃত্যুটা কোনভাবে কোন পথে হবে। তেমনি ইব্রাহিম মোল্লাও জানতেন না তার মৃত্যু কত কাছাকাছি।
খবরে প্রকাশ, গত ২২ অক্টোবর দারুসসালাম থানার পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ইব্রাহিম মোল্লা দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। খুনের ঘটনায় মূল আসামি পালিয়ে গেলেও গ্রেফতারকৃত সহযোগী মাসুদ রানাকে ইতোমধ্যে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ফ্লাইওভারের ওপরে চেকপোস্টে একটি ট্রাককে থামানোর নির্দেশ দিলে ট্রাকটি সুজন নামের এক পুলিশ কনস্টবলকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। তার দুদিন আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর নরায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিমপুর চেকপোষ্টে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় রাশেদুল নামের এক পুলিশ সদস্য আহত হন। গত ২৩ জুলাই’১৫ কক্সবাজার সৈকতে লাবণী পয়েন্টে ৪-৫ জন ছিনতাইকারী কয়েকজন পর্যটকের গতিরোধ করে সাথে থাকা মালামাল নিয়ে পালানোর সময় পুলিশ সদস্য পারভেজ তাদেরকে ধাওয়া করলে তারা পেছন দিক থেকে পারভেজকে ৮টি ছুরকাঘাত করলে কিছু সময় পর সে মারা যায়। গত ৮মে কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার চেকপোষ্টে তল্লাশির সময়ে সন্ত্রাসীদের মাইক্রোবাস চাপায় দেলোয়ার হোসেন নামে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন।

এমনিভাবে খুলনার কয়রায় আসামি ধরতে গিয়ে কয়রা থানা পুলিশের কনস্টেবল মোখলেস সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মারা যান। এছাড়া সবচেয়ে আলোচিত ময়মনসিংহে পুলিশ খুন করে কথিত জেএমবির আসামি ছিনতাই এর ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ মর্মাহত। তল্লাশি অভিযান পরিচালনাকালে খোদ পুলিশকে প্রাণ দিতে হবে তা হয়তো কেউ ভাবেনি, তবুও ঘটছে এমন ঘটনা। পুলিশ সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের উপকার করেছেন, নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছেন, দেশের সুনাম বজায় রাখছেন সে দৃষ্টান্তও কম নয়।

চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যরা লাইনে দাঁড়িয়ে ও সন্দেহভাজনদের হাত উঁচু করে তল্লাশি চালানোর নিয়ম রয়েছে। এ সময় অস্ত্র নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। তাই নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে আরো সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ নিহতের ঘটনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত অপরাপর পুলিশ সদস্যদের চরম গাফলতি ও অবহেলায় প্রায়শই তারা খুন হচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে একতা না থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাত, ডাকাতের গুলি, সন্ত্রাসীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের আঘাতে পুলিশ সদদ্যরা আর যাতে নিহত ও আহত না হন সে জন্য তাদেরকে আরো দক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বেলায় ‘দেখা গুলি করার নির্দেশ’ এ নিয়ম পালন করতে পুলিশ সচেষ্ট হলেও সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের বেলায় তারা কেন হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারছেনা সে প্রশ্নও থেকে যায়। পুলিশ যদি নিজেদেরকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এক লাখ ৬০ হাজার বিদেশিসহ দেশের প্রায় সতের কোটি মানুষকে নিরাপত্তা দিবে কিভাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

তাছাড়া, “যারা দেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নে বিশ্বাস করে না তারাই পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের হত্যা করছে” পুলিশের আইজি মহোদয়ের এমন সস্তা বক্তব্য সঠিক তদন্ত ও ন্যায় বিচারকে বাধাগ্রস্ত করবে। যে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তদন্তের আগে তার সাথে বিএনপি-জামায়াতকে জড়িয়ে বক্তব্য রাখলে সেই তদন্ত আর সত্যতার নিরিখে হয় না। এতে করে মামলা ও বিচার ব্যবস্থা হয় প্রশ্নবিদ্ধ। তাই কোন অপরাধের কারণ ও প্রকৃত জড়িতদের আইনের আওতায় না এনে মন্তব্য করলে তা হয় ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। তাই অপপ্রচার বন্ধ করে সুস্থ রুচির পরিচয় দিতে হবে। রাজধানীতে পুলিশ খুন হওয়াকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়া শুভ লক্ষণ নয়। কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হালকা করার চেষ্টা করা হয়। আমরা শুনেছি, ব্যক্তি বিশেষে বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংজ্ঞাও ভিন্ন ভিন্ন। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হয়তো খুব সহজেই দায় এড়ানো যায় তাই এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করার প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ বক্তব্যই শুনতে চাই। মুখে যা আসবে তাই বলবেন এ সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। অন্যদিকে পুলিশের ইতিবাচক কর্মকান্ডে মানুষ যেমন মুগ্ধ তেমনি তাদের কারও কারও অপকর্মের ফলেও মানুষ ক্ষুব্ধ ও অতীষ্ঠ। পুলিশের একশ্রেণির বিতর্কীত ভূমিকায় দেশে খুন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, বিদেশি নাগরিক হত্যাসহ নানা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বড় কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেমে নেই পুলিশের অপরাধ বাণিজ্য। ২ বছরে ১২ হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ (ইনকিলাব, ১আগস্ট, ’১৫)। ৫ বছরে ৬৮ হাজার সদস্যের বিভিন্ন অপরাধ- খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই মানবপাচারসহ গুরুতর অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ (ইনকিলাব, ১৫ জুন, ’১৫)। এক বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে ৪০ অভিযোগ। (প্রথম আলো, ২মে, ’১৫)। নগরবাসীর আতঙ্কের নাম পুলিশের সিভিল টিম (আমার দেশ অনলাইন, ২২ জুন ’১৫)। পুলিশের অপরাধ খুঁজে পায় না পুলিশ, বেড়েই চলছে অপরাধ প্রবণতা (মানবজমিন, ১ মে, ’১৫)। গত ২ ফেব্রয়ারি রাজধানীর পল্লবী এলাকায় নাহিদ নামে এক যুবককে অপহরণের পর চাহিদানুপাতে অর্থ না পাওয়ায় হত্যার অভিযোগ উঠেছে পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক তৌহিদুল আরেফিনসহ দ’ুজনের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের নয় মাসে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ১৪৮ জন নিহত হয়েছে বলে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে (যুগান্তর, ৩০ সেপ্টেম্বও, ’১৫)। এসব শিরোনামকে আমলে নিয়ে নিজেদেরকে সংশোধনের পথে পরিচালনা করা উচিত।

কোনো কোনো বেপরোয়া পুলিশ সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। যার ফলে অপরাধ বাড়ছে। সেই সাথে জনঅসন্তোষও দেখা দিচ্ছে। রাজনৈতিক মামলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করতে অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে মামলা করা হয়। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার এলাকায় অনেক পুলিশ সদস্যদের বাড়ি হওয়ায় পুলিশের বেপরোয়া ঠেকানো যাচ্ছেনা। গত ৩১ জুলাই দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে, ‘পুলিশের একাংশ বেপরোয়া’। এছাড়া ৯মে, ’১৫ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে এক প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ‘পুলিশে নিয়ন্ত্রণহীন অপরাধ’। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে প্রতিমাসে গড়ে ১২৫০ জন পুলিশ সদস্য নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে যেসব কর্তা ব্যক্তিরা রয়েছেন তাদের উচিত অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে খতিয়ে দেখে সঠিকভাবে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা তাহলে এই বাহিনীর সুনাম বৃদ্ধি পাবে। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে ছেলের সামনে মাকে অকথ্য নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় জনসাধারণের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণে ৩ জন নিহত ও অন্তত ৫০জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে স্থানীয় জনগণ বিক্ষোভ মিছিল করেছে। নিরীহ জনগন এমন কি করলো যে, তাদেরকে গুলি করে মারতে হবে? এসব বিষয় ভেবে দেখা উচিত। জনগণের সমস্যা ও প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

আইনশৃঙখলা বাহিনীর কাজ কি শান্তি-শৃঙখলা রক্ষা করা নাকি শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে বিঘ্ন ঘটানো? যখন যে চাইবে তখন সে গুলি করতে পারবে এই নিয়ম বলবৎ থাকা কখনই কল্যাণকর নয়। জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাঠিচার্জ করা যেতে পারে কিন্তু সরাসরি গুলি করার নির্দেশ কেন? সাধারণ মানুষ অপরাধ করলে কিংবা কোন কারণে পুলিশের রোষানলে পড়লে পুলিশের ভাষায় গিটা, বাদুড়, ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, ডিস্কো ড্যান্স, সিলাই, ঝাল মুড়ি, টানা ও বাতাস ইত্যাদি শাস্তি ভোগ করতে হয়। অথচ যখন কোন পুলিশ সদস্য বড় ধরণের অপরাধ করেন, তখন তাকে শাস্তি দেয়া হয় “ক্লোজ করে নেয়া”। ক্লোজ এর অর্থ হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাউকে সাসপেন্ড করা। সাসপেন্ডের মেয়াদ শেষ হলে তারা আবার যোগদান করেন। পুলিশ সদস্যরা যে কাউকে হত্যা করবে আর এ জন্য শাস্তি হলো শুধু ক্লোজ করা! এটা কি ন্যায় বিচার? এটা কি আইনের শাসন? না, তা হতে পারে না। সাধারণ মানুষ অপরাধ করলে আকাশের তারার মতো পুলিশের কাছে ধারার অভাব থাকে না। আর পুলিশের অপরাধের বেলায় আইনের নাকি ধারা খুঁজে পাওয়া যায় না! পুলিশের অপরাধের শাস্তি হিসেবে ক্লোজ করার বিধান যেন শাস্তি নামের প্রহসন ব্যতীত কিছই নয়।

আইনশৃঙখলাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের কারো না কারো স্বজন । আমরা তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। তাদের ভালবাসি। দেশ পরিচালনায় তারা মহান একটি দায়িত্ব পালন করছেন। মানুষের সেবায় তারা বেশ সচেতন। কিন্তু তাদের কতিপয় সদস্যের বিতর্কীত কর্মকান্ডের কারণে গোটা আইনশৃঙখলা বাহিনী যেন দিন দিন সমালোচনার মুখে পড়ছে। সামগ্রীকভাবে তাদের ইতিবাচক কাজের চেয়ে নেতিবাচক দিকটিই বেশি ফুটে উঠছে। যারা অসৎচরিত্রের অধিকারি তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া উচিত। তারা সংশোধন না হলে তাদেরকে প্রতিহত করা নৈতিক দায়িত্ব।
সুশাসন না থাকায় মানুষের আদালত থেকে কেউ ছাড়া পেলে পরকালে নিঃসন্দেহে সবাইকে মহান আল্লাহর কাছে তার কৃত কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সরকারের। তাই আমরা আশা করি প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে যেন ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হয়। তাই পুলিশের আচরণ ও পুলিশের সাথে আচরণ দু’টোই প্রশংসনিয় ও কল্যাণকর হওয়া উচিত।

 

 

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G